ক্ষত
-বিশ্বদীপ মুখার্জী
পর্ব- ৪
স্কুটিটা এসে দাঁড়ালো পানের দোকানের ঠিক দশ হাত পেছনে। তখন ঘড়িতে সকাল ন’টা বেজে দশ মিনিট। রোদের তেজ ধীরে ধীরে কড়া হবে। যতক্ষণ না প্রতীক নেলসন বাড়ি থেকে বেরোয় আর বিকাশ আসে, ততক্ষণ এক এমন জায়গায় দাঁড়াতে হবে যেখানে রোদের তাপও পৌঁছবে না আর প্রতীকের চোখের আড়ালেও থাকা যাবে। কিন্তু এমন জায়গা এখানে কোথায়? গলির মুখের ঠিক উল্টো দিকে একটা সাইবার ক্যাফে। এই মাত্র সেটার শার্টার খুললো। মৃত্যুঞ্জয় ও অন্বেষা এক অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলো। মৃত্যুঞ্জয়ের চোখের ইশারা অন্বেষা বুঝতে পেলো। দু’জনে এগিয়ে গেলো সে দিকে।
‘বসা যেতে পারে কি?’ দোকানিকে জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসুন না।’ দাঁত বার করে হেসে দোকানি বললো। সকালে দোকান খুলতেই যে গ্রাহক চলে আসবে, ভাবতে পারেনি সে। গ্রাহক দেখে নিজের খুশি কে সামলে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হলো না।
একটা কম্প্যুটারের সামনে অন্বেষা বসলো। কিছু একটা করতে হবে তাই খুলে নিলো নিজের ফেসবুক প্রোফাইল।
‘তুমি বসবে না।’ অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়কে।
‘না, আমার বসলে চলবে না।’
সাইবার ক্যাফের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল সে।
সকাল ন’টা চল্লিশ। অন্বেষার মোবাইল বেজে উঠল।
‘হ্যাঁ বল….ক’টায়?….ঠিক আছে..তুই কি পৌঁছে গেছিস? ..ঠিক আছে, রাখলাম।’
‘রাধিকার ফোন নিশ্চয়ই?’ অন্বেষার ফোন রাখার পর তাকে জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘হ্যাঁ। রাধিকা পাটনা জংশন পৌঁছবে। শি ইজ অন দি ওয়ে। প্রতীক তাকে বলেছে যে ঠিক দশটায় সে বাড়ি থেকে বেরোবে।’ অন্বেষা বলল।
দশটা বেজে দশ মিনিটে নিজের বাসস্থান থেকে বেরিয়ে গলির মুখে এলো প্রতীক নেলসন। নিজের বাঁ দিকে মুড়ে পানের দোকানের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলো সে। নতুন কোনো ক্ষতচিহ্ন তার শরীরে মৃত্যুঞ্জয় দেখতে পেলো না।
‘এখনও বিকাশ এলো না?’ কম্প্যুটার বন্ধ করে মৃত্যুঞ্জয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘যতক্ষণ না প্রতীক এই কলোনী ছাড়ছে, বিকাশ ঢুকবে না। তাকে যদি প্রতীক এক বার ভুল করেও দেখে নেয় তাহলে আমাদের পুরো প্ল্যান ভেস্তে যাবে। বিকাশ এখন কংকড়বাগ কলোনীর ঠিক বাইরে এক পিৎজা হাটে আমাদের জন্য পিৎজা কিনছে। সে নজর রেখেছে রাস্তার দিকে। যে মুহূর্তে কলোনী থেকে বেরিয়ে প্রতীক অটো ধরবে, সে দোকান থেকে বেরিয়ে চলে আসবে এ দিকে।’
সাইবার ক্যাফের ছেলেটাকে টাকা দিয়ে দু’জনে বেরিয়ে এলো। পানের দোকানের দিকে এক বার তাকালো মৃত্যুঞ্জয়। গ্রাহক খুব একটা নেই। দু’টো বয়স্ক লোক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে জমিয়ে গল্প করছেন।
‘অন্বেষা, তুমি স্কুটি নিয়ে সোজা প্রতীক নেলসনের বাড়ির সামনে দাঁড়াও। আমি বরং একটা পান খেয়ে আসি।’
‘পান!’ চমকে উঠল অন্বেষা।
‘হুম, পান। তুমি এগিয়ে যাও।’
অন্বেষা কথা না বাড়িয়ে স্কুটি নিয়ে এগিয়ে গেলো। মৃত্যুঞ্জয় গিয়ে দাঁড়ালো পানের দোকানের সামনে। দোকানি একবার দেখেই চিনতে পেলো তাকে। এক গাল হেসে বলল- ‘আপ! আইয়ে আইয়ে।’
এক প্যাকেট সিগারেট কিনে মৃত্যুঞ্জয় তাকে বলল – ‘দরকারী কথা আছে তোমার সাথে।’
‘বলিয়ে না বাবু। কেয়া বাত হ্যায়?’
মৃত্যুঞ্জয় ইশারা করে তাকে দোকান থেকে বেরিয়ে আসতে বললো। ঠিক সেই সময় বেজে উঠল মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইল। বিকাশের কল।
কল রিসিভ করতেই ওপার থেকে বিকাশ বলল- ‘প্রতীক অটোতে বসে পড়েছে। আমার পিৎজা কেনা হয়ে গেছে। আমি আসছি।’
‘ঠিক আছে।’ ফোন কেটে দিলো মৃত্যুঞ্জয়।
দোকানিকে জিজ্ঞেস করলো- ‘কিছুক্ষণ আগে হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা এক ছেলে তোমার দোকানের সামনে দিয়ে চলে গেলো। তাকে চেনো নিশ্চয়ই?’
‘হাঁ বাবু। এটাই তো থাকে ওই বাড়িতে।’ দোকানি বলল।
নিজের পার্স থেকে দুশো টাকার একটা নোট বার করে দোকানির হাতে দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘যে ছেলেটা রোজ বিকেলে তোমার থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট কিনে সেই বাড়িতে যায়, তার সাথে আমি আজ যাবো সেই বাড়িতে। সে কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে। এই কথাটা যেন কেউ জানতে না পারে।’
দোকানি স্বছন্দে টাকাটা নিয়ে নিলো। বলল- ‘বাবু, এর আগেও আপনি আমার ওপর দয়া দেখিয়েছেন। আমি আপনার কথা না তো কাউকে বলেছি, আর না কাউকে বলবো।’
‘ভেরি গুড।’ দোকানির পিঠে এক চোপড় মেরে বলল মৃত্যুঞ্জয়।
নিজের স্কুটি দাঁড় করিয়ে বাড়ির সামনে মৃত্যুঞ্জয়েের অপেক্ষা করছে অন্বেষা। মৃত্যুঞ্জয়কে আসতে দেখেই বলল- ‘তোমার যে পানের নেশা আছে সেটা আমি জানতাম না তো?’
মৃত্যুঞ্জয় হেসে বলল- ‘পানের নেশা নয় সোনা আমার, কাজের নেশা। আসলে ওই দোকানিকে হাতের মুঠোয় আনা দরকার ছিলো।’
‘কী করে আনলে তাকে নিজের হাতের মুঠোয়?’
‘ভেরি সিম্পল, টাকা দিয়ে। যে দিন প্রথম আমি এখানে আসি সে দিনও তাকে টাকা দিয়েছিলাম নিজের মুখ বন্ধ রাখার জন্য। আজকেও তাই করলাম। আমরা যে এখানে এসেছিলাম সে খবর প্রতীক নেলসন পর্যন্ত যাবে না। আর হ্যাঁ, ভালো কথা, বিকাশের কল এসেছিল। প্রতীক অটোতে চড়ে গেছে। বিকাশের পিৎজা কেনা হয়ে গেছে। সে কিছুক্ষণের মধ্যে এখানে পৌঁছে যাবে।
বিকাশের পৌঁছাতে আরও দশ মিনিট সময় লাগলো। এসেই অন্বেষাকে সে জিজ্ঞেস করলো- ‘রাধিকার কোনো ম্যাসেজ এসেছে?’
‘প্রতীকের রওনা হওয়ার পর কোনো ম্যাসেজ আসেনি।’ জবাব দিলো অন্বেষা।
বাইকের ডিকি থেকে বেশ বড় রকম একটা হাতুড়ি বার করে সেটাকে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বিকাশ বলল- ‘এতে কাজ হবে তো?’
‘আলবৎ হবে। আচ্ছা বিকাশ, তুমি প্রতীক নেলসনের হাতে কোনো দিন মেডিকেলের বই দেখেছো?’
‘মেডিকেলের বই? কই, নাতো। কেন বলো তো?’
‘বাড়ির আশেপাশে প্রচুর বইয়ের প্রায় অর্ধেক পুড়ে যাওয়া পৃষ্ঠা পাওয়া গেছে। সেই পৃষ্ঠাগুলো মেডিকেল বইয়ের।’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
খানিক চিন্তা করে বিকাশ বলল- ‘না, মেডিকেলের বই দেখিনি। হয়তো তার ঘর থেকে পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রতীকের মেডিকলের সাথে কী সম্পর্ক হতে পারে?’
‘সেটাই তো প্রশ্ন বিকাশ, সেটাই তো প্রশ্ন। সব প্রশ্নের না হোক, কিছু প্রশ্নের উত্তর যে আজ পাওয়া যাবেই সেটা আমার বিশ্বাস।’
নিজের মোবাইল ঘাঁটছিলো অন্বেষা। হঠাৎ সে বলল- ‘রাধিকার ওয়াটসঅ্যাপ করেছে। প্রতীকের সাথে তার দেখা হয়েছে। তারা গান্ধী ময়দানে কোনো এক রেস্তোরাঁতে জলখাবার খেয়ে সিনেমা দেখতে যাবে।’
‘গুড। ভেতরে যাওয়া যাক।’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
ফটক খুলে ভেতরে ঢুকতেই চারিপাশে চার ফুটের পাঁচিল ও আগাছা। মাঝখানে একতলা ছোট বাড়ি। ছ’ ধাপ সিঁড়ি উঠে সদর দরজা। সেটা খুলে ভেতরে ঢুকতেই অন্ধকার প্রায় বাড়িতে প্রবেশ করলো তারা। বাড়ির সব জানালা বন্ধ, একটা বাতিও জ্বলছে না। সুইচ বোর্ড কোথায় সেটা খুব ভালো করেই জানে বিকাশ পান্ডে। দু’তিনটে সুইচ পরপর টিপতেই বেশ কিছু আলো জ্বলে গেলো। তারা দাঁড়িয়ে আছে এক ছোট ডাইনিং হলে। আদ্যিকালের দুটো কাঠের আলমারি ছাড়া বেশ কিছু আবর্জনা ছড়ানো চারিদিকে। ডাইনিং হলের ডান দিকে রান্না ঘর। বলাই বাহুল্য সেটাও বন্ধ। পাশাপাশি দুটো ঘর। ডান দিকের ঘরটা বিকাশের এবং বাঁ দিকেরটা প্রতীকের। নিজের ঘরের তালা খুললো বিকাশ। তিন জনেই ভেতরে ঢুকলো। বিকাশ এগোলো ঘরের জানালা খুলতে, কিন্তু তাকে মানা করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘জানালা খুলতে হবে না। লাইট জ্বালিয়ে দাও। বাইরের কেউ যেন দেখতে না পায়ে যে এ বাড়িতে কেউ আছে।’
অগত্যা লাইট জ্বালাতে হলো বিকাশকে । ছোট ঘর। জানালার দিকে একটা চৌকি পাতা। দুটো কাঠের টেবিল, একটা চেয়ার। টেবিলে নানা ধরনের টেস্ট টিউব। এক দিকের দেয়ালে বড় এক তাক বানানো আছে। সেই তাক জুড়েও বিভিন্ন ধরন ও আকৃতির শিশি বোতল ও টেস্ট টিউব। কোনো টেস্ট টিউবে নীল রঙ্গের জল তো কোনো টেস্ট টিউবে লাল অথবা হলুদ জল। সেগুলো যে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল সেটা বুঝতে সময় নিলো না মৃত্যুঞ্জয়। ছাদে ঝুলছে আদ্যিকালের এক সিলিং ফ্যান। সুইচ দিতেই বিকট এক শব্দ করে সেটা ঘুরতে আরম্ভ করলো। চেয়ারে বসলো অন্বেষা। টেস্ট টিউবগুলোকে ভালো করে নিরীক্ষণ করতে শুরু করলো সে। খানিক নিরীক্ষণ করার পর যখন কিছুই বুঝলো না তখন সেখান থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বিকাশের হাতে একটা প্যাকেট। সেটা খুলে ভেতর থেকে তিনটে পিৎজা বার করে সে বলল- ‘মধ্যপ্রদেশে হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেছে। সেটাকে শান্ত করা দরকার।’
প্রাতঃরাশ শেষ হওয়ার পর মৃত্যুঞ্জয় বিকাশকে জিজ্ঞেস করলো- ‘তুমি তো অনেক দিন ধরেই প্রতীককে চেনো। কোনো দিন কিছু বলেছে নিজের অতীতের বিষয় তোমাকে? কোনো দিন জিজ্ঞেস করেছো তুমি?’
‘জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু কোনো দিনই বিশেষ কিছু বলেনি সে। যত বার জিজ্ঞেস করেছি, ততবার কথা এড়িয়ে গেছে। তবে হ্যাঁ, রাধিকাকে বলেছে। সে কোন স্কুল, কলেজে পড়েছে সে সব। এর থেকে বেশি কিছু হাজার চেষ্টা করেও রাধিকা তার মুখ থেকে বার করতে পারেনি।’
‘অদ্ভুত রহস্যময় ছেলে মাইরি। অনেক ছেলের সাথেই আমার পরিচয় আছে, কিন্তু এমন বিচিত্র, এমন কমপ্লিকেটেড ছেলে কোনো দিন দেখিনি।’ বলল অন্বেষা।
‘হুম। তাই তো এই কেসের প্রতি রুচি দেখলাম আমি।’ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
এদিক ওদিকের কথায় এগিয়ে চললো সময়। এক সময় ঘড়ি দুপুর একটা বাজার ইঙ্গিত দিলো। বাইরে রোদের তাপ বেশ ভালোই বেড়েছে। লোকের চলাচল যে কমেছে সেটা বলাই বাহুল্য। হাতুড়ি দিয়ে প্রতীকের তালাতে দুু’তিনটে জোরে ঘা দিলো মৃত্যুঞ্জয়। চকিতে তালার আকৃতিতে পরিবর্তন ঘটলো। ফটকের ও সদর দরজার তালারও একই অবস্থা হলো। তদন্তের খাতিরে নিজের বেশ কিছু টেস্ট টিউবকে জলাঞ্জলি দিতে হলো বিকাশকে। এটা করতে যে বুক ফেটে গেলো সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গেলো।
‘টেস্ট টিউব গুলোর দাম অনেক। আবার কিনতে হবে।’ বিষণ্ণতা ভরা কণ্ঠে বলল বিকাশ পান্ডে।
অতঃপর তারা এগোলো প্রতীক নেলসনের ঘরের দিকে। হাতুড়ি মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে। তালায় চারবার সজোরে প্রহার করতে হলো তাকে। তালা ভেঙ্গে হাতে চলে এলো তার। অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালিয়ে ঘরটাকে আলোকিত করলো বিকাশ। দু’টো ঘরের আকার ও আকৃতি একই। আসবাবপত্র বলতে একটা চৌকি, একটা ছোট্ট স্টিলের আলমারি, একটা কাঠের টেবিল ও চেয়ার এবং কিছু বাসনপত্র। ঘরে যে কেউ থাকে সেটা ঘরের অবস্থা দেখে বলা সম্ভব নয়। অপরিচ্ছন্নতায় পরিপূর্ণ ঘর।
বাসনপত্রের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘বাসন আছে অথচ গ্যাস দেখছি না। প্রতীক কি বাইরে থেকে খাবার প্যাক করিয়ে নিয়ে আসে নাকি?’
‘হ্যাঁ।’ জবাব দিলো বিকাশ।
চৌকিতে পাহাড় করে রাখা জামাকাপড়। সেগুলো কে একে একে উঠিয়ে দেখলো মৃত্যুঞ্জয়। অন্বেষা ও বিকাশও ঘরের প্রতিটি কণা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখতে শুরু করলো। চৌকিতে রাখা বেশ কিছু বেল্টের ওপর নজর গেলো মৃত্যুঞ্জয়ের। ভালো করে সেগুলোকে দেখে যথাস্থানে রেখে দিলো সে। হঠাৎ তার নজর গেলো দেয়ালের দিকে। সাদা দেয়াল, তাতে অল্প অল্প রক্তের দাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সে দিকে খানিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে টেবিলের দিকে এগোলো মৃত্যুঞ্জয়। মোটা মোটা বেশ কিছু বই এবং এক ব্লুটুথ মিউসিক সিস্টেম সেখানে। কোনোটা ছেঁড়া, কোনোটা অর্ধেক পুড়ে যাওয়া। মৃত্যুঞ্জয় দেখলো সব বইগুলো মেডিকেলের। বইগুলোর শেষাংশগুলোই ভালো করে দেখলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘মৃত্যুঞ্জয়দা, এদিকে এসো।’
হঠাৎ অন্বেষার কন্ঠস্বর শুনতে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। চৌকির পেছন দিকে এক কোণায় উবু হয়ে বসে আছে অন্বেষা। তার নজর চৌকির নিচের দিকে। অন্বেষার ডাকে মৃত্যুঞ্জয় আর বিকাশ ছুটে গেলো সে দিকে।
‘কী হলো?’ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
অন্বেষা ইশারা করলো চৌকির তলার দিকে।
পুরো ঘরের তুলনায় চৌকির তালাটা বেশ পরিস্কার। বেশ বড় আকারের চৌকো কাঠের বাক্স রাখা সেখানে। সেটাকে টেনে বার করলো মৃত্যুঞ্জয়। বাক্সটাকে কাঠের সুটকেস বললে ভুল বলা হয় না। প্রায় পাঁচ ফুট বাই চার ফুটের। বাক্সটা ছিলো এক তোয়ালে দিয়ে ঢাকা। ধুলোর লেশমাত্র নেই বাক্সর গায়ে। পুরো ঘরে এই একটি মাত্র জিনিস যেন যত্ন সহকারে রাখা।
‘কী হতে পারে এটা?’ জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘যতদূর মনে হয়ে ফাস্ট এড বক্স। তা ছাড়া অন্য কিছু হবে বলে তো মনে হয়ে না।’
কথা শেষ করে মৃত্যুঞ্জয় খুলল সেটাকে। চাবি দিয়ে লক করার জায়গা আছে বটে, কিন্তু লক করা ছিলো না সেটা। বক্সের ভেতরে আছে গোল করে পেঁচানো দুটো বেল্ট, বেশ কিছু ব্লেড, ছুরি, ব্যান্ডেজ, স্টিচ করার সুতো, অপারেশনে ব্যবহার করার কিছু কাঁচি। সাথে আছে চারটে কাগজের ছোট ছোট টুকরো। বাক্সটা বিকাশের হাতে দিয়ে কাগজের টুকরোগুলো বার করলো মৃত্যুঞ্জয়। প্রথম টুকরো তে লেখা আছে- এস 1, দেয়াল। দ্বিতীয় টুকরোতে লেখা আছে- এস 2, বেল্ট । তৃতীয়তে- এস 3, ব্লেড ছুরি। এবং চতুর্থ কাগজের টুকরোতে লেখা আছে- এস 4।
‘এটা কী হেঁয়ালি মৃত্যুঞ্জয় দা?’ বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
অন্বেষার প্রশ্ন যেন মৃত্যুঞ্জয়ের কানেই গেলো না। ভ্রুকুটি করে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল কাগজের সেই রহস্যময় টুকরোগুলোর দিকে।
‘এস 4এর পাশে কিছু লেখা নেই কেন?’ প্রশ্নটা করলো বিকাশ পান্ডে।
মৃত্যুঞ্জয় এবারও চুপ। ঘরে খানিক নিস্তব্ধতা ছেয়ে থাকলো। কাগজের ওপর থেকে নজর সরিয়ে খানিক শূন্যের দিকে চেয়ে রইল মৃত্যুঞ্জয়।
‘অন্বেষা, বিকাশ, দেখো ভালো করে। আরও যদি কিছু পাও।’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
চৌকিতে জামাকাপড়ের স্তুপের মধ্যে ছিলো একটা ব্যাগ। ব্যাগেও কাপড়ের পাহাড়। না, আর বিশেষ কিছুই পেলো না তারা।
‘ঠিক আছে। বিকাশ, এবার তুমি ফোন করো প্রতীককে। তুমি জানো তোমায় কী বলতে হবে।’
মৃত্যুঞ্জয়ের কথা মতো বিকাশ ফোন করলো প্রতীককে । কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর প্রতীক ফোন তুলতেই কান্না মেশানো স্বরে বিকাশ বলল- ‘প্রতীক, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমি এখনই বাড়ি এসেছি। সব তোলপাড় হয়ে গেছে। জানি না চোর এসেছিল কিনা। তালা ভেঙ্গে দিয়েছে সব। তোর ঘরের, আমার ঘরের। আমার বেশ কিছু দামী টেস্ট টিউব ভেঙ্গে দিয়েছে। তুই যেখানেই আছিস, চলে আয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
বিকাশের ফোন রাখার পর অন্বেষা তাকে বলল- ‘বেশ ভালোই অভিনয় করতে পারো তুমি।’
বিকাশ রয়ে গেলো সেখানে। মৃত্যুঞ্জয় আর অন্বেষা যখন বেরলো তখন বিকেল চারটে। প্রতীকের সেখানে পৌঁছবার আগেই এক রেস্তোরাঁ থেকে কিছু খাবার প্যাক করে দিয়ে গেলো মৃত্যুঞ্জয়। খিদে তাদেরও পেয়েছিল। কংকড়বাগ থেকে বেরিয়ে পাটনা জংশনের কাছে নিউ মার্কেটের একটা রেস্তোরাঁতে ঢুকলো মৃত্যুঞ্জয় আর অন্বেষা। খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর অন্বেষা মৃত্যুঞ্জয়কে বলল- ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। সেই কাগজের টুকরোগুলো কি কোনো সংকেত? যদি সংকেতই হয়, তাহলে কিসের সংকেত সেগুলো? এস 1, এস 2 এগুলো তো ট্রেনের কামরায় লেখা থাকতে দেখেছি। রিজার্ভেশন কম্পার্টমেন্টে।’
‘তা দেখেছো হবে। কিন্তু এটার ট্রেনের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। প্রথম কাগজে কী লেখা ছিলো?’
‘এস 1 আর দেয়াল।’ বলল অন্বেষা।
‘দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখেছো ভালো করে?’ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
খানিক চিন্তা করে অন্বেষা বলল- ‘কিছু বিশেষ তো পাইনি।’
‘তার মানে তুমি লক্ষ করোনি। দেয়ালের গায়ে ছিলো রক্তের দাগ। রক্তের দাগ আমি পেলাম কাঠের বাক্সতে রাখা বেল্টেও, সাথে ব্লেড আর ছুরিতে তো ছিলোই। এবার ভালো করে চিন্তা করে দেখো। প্রথম কাগজ …. দেয়ালে রক্তের দাগ, দ্বিতীয় কাগজ …. বেল্টে রক্তের দাগ, তৃতীয় কাগজ …. ব্লেড ও ছুরিতে রক্তের দাগ। কিছু বুঝতে পেলে?’
প্রচুর মাথা ঘামিয়েও কিছু বুঝতে পারছে না অন্বেষা। চারটে চিরকুট, তাতে কিছু সাংকেতিক শব্দ, রক্তের দাগ। না, পারছে না সে। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে তার। মাথা ধরে চুপ করে বসে রইলো অন্বেষা। খাবার চলে এসেছে। খাবার সময় হঠাৎ অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো- ‘চার নম্বর চিরকুটটা খালি কেন? তাতে দেয়াল, ব্লেড কিছুই তো লেখা নেই।’
‘গুড কোয়েশ্চন? তোমার কী মনে হয়, কি লেখা যেতে পারে তাতে?’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
‘আমি কি করে বুঝবো?’
‘ভেবে দেখো। সমীকরণগুলোকে এক এক করে মিলিয়ে দেখো।’
‘তুমি তো এমন করে বলছো যে রহস্যের সমাধান তুমি করে ফেলেছো।’
খাবার থেকে চোখ সরিয়ে শূন্যের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বল – ‘পুরো সমাধান এখনও হয়নি। তবে কিছুটা তো অবশ্যই করে ফেলেছি।’
‘সমাধান করে ফেলেছো? কী বুঝলে?’ উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘বলবো।’
বাড়ি যাওয়ার পথে আর কোনো কথা হলো না তাদের মধ্যে। বাড়ি যখন পৌঁছালো তারা তখন ঘড়িতে বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। মৃত্যুঞ্জয় সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। দরজা বন্ধ করে দিলো ভেতর থেকে। অন্বেষা নিজের ঘরে বসে নিরন্তর ভাবতে থাকে কাগজের সেই টুকরোগুলো এবং তাতে লেখা সাংকেতিক শব্দ গুলোর বিষয়। সে যা যা দেখেছে, মৃত্যুঞ্জয় তাই দেখেছে। তাহলে মৃত্যুঞ্জয় কী এমন আবিষ্কার করে ফেললো যেটা সে পারলো না। মৃত্যুঞ্জয় এই কেসে যদি অন্বেষাকে সাহায্য না করতো তাহলে কি অন্বেষা কোনো কূলকিনারা বার করতে পারতো এই রহস্যের? কথাটা ভেবে নিজের মনেই হেসে ফেললো অন্বেষা। মৃত্যুঞ্জয়দার অবজারভেশন ক্ষমতার সামনে মাথা নত করতেই হয়। কিন্তু তার অবজারভেশন কী বলে সেটা জানার জন্য মনটা ছটফট করে উঠল অন্বেষার। এখন কি মৃত্যুঞ্জয়দার ঘরে ঢোকা ঠিক হবে? সারা রাস্তা কোনো কথা বলেনি সে। বাড়িতে এসেও সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। নিশ্চয়ই এই রহস্য নিয়ে চিন্তার গভীর সাগরে ডুবে আছে সে। তাকে কি এই সময় বিরক্ত করা ঠিক হবে? কিন্তু নিজের মনের ছটফটানিকে যে কিছুতেই কম করতে পারছে না সে। জীবনে প্রথম বার অন্বেষা কোনো রহস্যের সম্মুখীন হয়েছে। এর শেষ না দেখা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। না, আর বসে থাকতে পারলো না সে নিজের ঘরে। বেরিয়ে পড়লো নিজের ঘর থেকে। সিঁড়ি বেয়ে মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা দিলো।
‘কে?’ ভেতর থেকে মৃত্যুঞ্জয়ের ব্যরিটোন আওয়াজ ভেসে এলো।
‘আমি অন্বেষা।’
দরজা খুললো মৃত্যুঞ্জয়। একটা চেয়ারে বসে অন্বেষা বলল- ‘অনেক ভাববার চেষ্টা করলাম মৃত্যুঞ্জয়দা। কিন্তু কিছুই মাথায় এলো না। বিচিত্র মানুষের বিচিত্র রহস্য। যেমন বিচিত্র সে, তেমন বিচিত্র তার চালচলন। কখনও হাত কাটা, কখনও মাথা ফাটা। জানো, এক দিন রাধিকা কী বলছিলো আমায়?’
মৃত্যুঞ্জয় খাটে বসে ঘাড় হেঁট করে নিজের মোবাইলের দিকে কি সব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। ঘাড় হেঁট করেই জিজ্ঞেস করলো- ‘কী বলছিলো রাধিকা?’
‘বলছিলো যে সে একদিন নাকি সোনপুর গিয়েছিলো। সেখানে তার মামার বাড়ি। ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো। গান্ধী সেতুর ওপর সন্ধ্যের আলোতে হঠাৎ সে প্রতীককে দেখতে পায়। গঙ্গার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলো সে। কৌতূহল হয়েছিল রাধিকার। সাথে তার মা-বাবা ছিলো তাই গাড়ি থামিয়ে প্রতীকের সাথে দেখা করতে পারেনি। প্রতীককে পরে সে জিজ্ঞেস করেছিলো বটে, কিন্তু চিরকালের মতো জবাব দেয়নি প্রতীক।’
এবার মৃত্যুঞ্জয় তাকালো অন্বেষার দিকে।
‘কী বললে? গান্ধী সেতুতে?’
‘হ্যাঁ।’ অন্বেষা বলল- ‘গঙ্গার ওপর একটা ব্রিজ আছে। মহাত্মা গান্ধী সেতু নাম। প্রায় ছ’কিলোমিটার লম্বা।’
‘আহাঃ .. সে সব জানি। সেখানে প্রতীক দাঁড়িয়েছিলো?’
‘হ্যাঁ।’
অন্বেষা দেখলো মৃত্যুঞ্জয়ের মুখটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। নিশ্চয়ই কিছু একটা ক্লু সে পেয়েছে। কৌতূহলী দৃষ্টিতে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে চেয়ে রইল অন্বেষা।
মৃত্যুঞ্জয় উৎসাহের সাথে বলল- ‘বুঝে গেছি। চার নম্বর চিরকুটে কী লেখা হতে পারে, সেটা বুঝে গেছি।’
‘কি?’ অন্বেষার কৌতূহল ক্রমে বাড়ছে।
নিজের মোবাইলটা খাটে রেখে ঘরময় পায়চারি শুরু করলো মৃত্যুঞ্জয়।
বলল- ‘প্রথম চিরকুটে দেয়াল, দ্বিতীয় চিরকুটে বেল্ট, তৃতীয় চিরকুটে ব্লেড, ছুরি আর চতুর্থ চিরকুটে …. ‘
মৃত্যুঞ্জয় তাকালো অন্বেষার দিকে। অন্বেষা গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে আছে মৃত্যুঞ্জয়ের পানে। অন্বেষার চোখে চোখ রেখে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘চতুর্থ চিরকুটে জল।’
‘জল!’ চমকে উঠল অন্বেষা- ‘কিন্তু তুমি কী করে শিওর?’
মৃত্যুঞ্জয় লঘু কদমে অন্বেষার দিকে এগোলো। জ্বলজ্বল করছে তার দু’টো চোখ। অন্বেষা যে চেয়ারে বসে, সে চেয়ারের দুটো হাতলে নিজের দুটো হাত রেখে, অন্বেষার দিকে ঝুঁকে এবং নিজের মুখ তার মুখের অত্যন্ত কাছে নিয়ে গিয়ে বলল- ‘তুমি হয়তো এটা জেনে অবাক হবে যে প্রতীক নেলসনের শরীরের আঘাতের একমাত্র কারণ প্রতীক নেলসন নিজে।’
‘মানে?’ অন্বেষার আশ্চর্য এবার নিজের সীমা লংঘন করলো।
মৃত্যুঞ্জয় পুনরায় শুরু করলো ঘরময় পায়চারি করা।
চলবে…………..